আষাঢ় মাস গত তিন দিন একটানা ঝুম বৃষ্টি। রাস্তাঘাট পানিতে থৈথৈ করছে, নদীনালা পুকুরের পানি রাস্তায় উঠে এসে ঘরবাড়ির সামনে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
এমন আবহাওয়ায় ঘর থেকে বের হওয়ার কোন উপায় না থাকলেও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পানিতে নেমে পড়েছে মাছ ধরতে।
কেউ কেউ গায়ের জামা খুলে চালনি বানিয়েছে, কেউ গামছা নিয়ে এসেছে। যতদূর চোখ যায় মানুষ খুব একটা দেখা যায়না, দু একটা রিক্সা রেক্সিনে মোড়ানো রিক্সা দেখা যায়। অদ্বিতীদের স্কুলে পানি উঠেছে এ কারণে স্কুল ছুটি।
নয়তলার উপরে ফ্ল্যাট বাসায় থাকে অদ্বিতীরা, কিছুই ভালো লাগছে না ওর। শরীরটা গত কয়েকদিন কেমন যেনো করছে, মা কিছুতেই বুঝতে চাইছেনা ওর খারাপ লাগছে। পড়ার টেবিলে বসা, টেলিভিশন দেখা , গল্পের বই পড়া কিছুই ভালো লাগছে না অদ্বিতীর।
কি ব্যাপার পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ জানালায় কি করো তুমি অদ্বিতী?
মা বৃষ্টি দেখি,
দেখো মা মনে হচ্ছে আমাদের বিল্ডিংটা একটা জাহাজ কেমন নদীতে ভাসছি আমরা।মা বললেন, “যাও পড়ার টেবিলে যাও, এসব দেখে সময় নষ্ট করোনা। ভুলে যেওনা এবার তুমি ক্লাস নাইনে উঠেছো। ”
অদ্বিতী বললো, “আমার শরীর ভাল লাগছেনা মা, মাথা ঘুরছে। শরীর কেমন যেনো করছে। ” “পড়তে বসতে বললেই ইদানিং তুমি এমন বাহানা শুরু করো।শরীরের দোহাই দাও। ” বলতে বলতে মা এসে অদ্বিতীর কপালে হাত ঠেকিয়ে আরও রেগে বললেন, “তোমার কপাল একেবারেই ঠান্ডা, এসব বাহানা করো না। যাও পড়ার টেবিলে যাও। ” মায়ের আদেশে পড়ার টেবিলে বসলেও পড়ায় এতোটুকু মন নেই। এই মুহুর্তে মা কে খুব অসহ্য লাগছে অদ্বিতীর।
লাবণীর মায়ের লাবণীর সাথে কি সুন্দর সম্পর্ক। ওরা একদম বন্ধুর মতো। লাবণী প্রায়ই বলে ওর মা ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ও সব কথা মায়ের সাথে শেয়ার করে। ভালমন্দ যা কিছু সব। লাবণী আর অদ্বিতী প্রথম শ্রেণী থেকে একসঙ্গে পড়ে। সেই থেকেই ওদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক।
লাবণীদের আর্থিক অবস্থা অদ্বিতীদের মতো এতোটা স্বচ্ছল নয়। সেই ছোটবেলায় অদ্বিতী যখন ভিন্ন ভিন্ন টিফিন নিয়ে যেতো স্কুলে, লাবণী তখন প্রতিদিন একই টিফিন নিয়ে যেতো। কোন কোন দিন ও বক্স বেরই করতোনা লজ্জায়।
অদ্বিতী বুঝতে পারতো। এমন অনেক দিন গেছে লাবণীর টিফিন বক্স সরিয়ে অদ্বিতী ওর বক্স লাবণীর ব্যাগে ভরে রেখেছে। এমন করে খুব অল্পদিনেই ওরা খুব আপন হয়েছে গেছে। অদ্বিতীর মনে হতো লাবণী খুব সুখী ওর মা বাবা আমার মা বাবার মতো নয়। ইস আমি যে কেন লাবণীর বোন হলাম না! গত সপ্তাহে ক্লাসে রাজিয়া ম্যাডাম বলেছেন, “বয়সন্ধীকালে শরীরে অনেক পরিবর্তন হয়। ছেলে এবং মেয়ে সবার হয়৷ এটি প্রাকৃতিক নিয়ম।
তখন মায়ের কাছে বলতে হয় শরীরের এবং মনের কথা। যদি কারো মা না থাকে তাহলে কাছের অন্য কাউকে বলতে হয়৷ অদ্বিতীর মাকে ভয় লাগে । মা এতো কঠিন করে কথা বলে। মা কে সবসময় হেড ম্যাডামের মতো মনে হয়৷ এইতো সেদিন স্কুলের শেষ ক্লাসে স্যার পড়াচ্ছিলেন, চ্যাপ্টার শেষ হতে ১৫ মিনিট দেরী হয়েছে। লাবনীর মা ওর পাশে দাড়ানো।
লাবণীর মা হেসে প্রশ্ন করলেন, ” কিরে মা, ক্লাস শেষ হতে দেরী হলো বুঝি। মুখ শুকনো লাগছে কেন তোদের ? টিফিন খাওয়ার সময় পাস নি তোরা?” অদ্বিতীর মা এসেই অদ্বিতীকে প্রশ্ন করলেন, “এই মেয়ে ছুটির পরে এতোক্ষণ কোথায় ছিলি? কার সাথে আড্ডা দিয়েছিস? সময়জ্ঞান নেই তোর, কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি সেই হিসাব আছে তোর? বেয়াদব মেয়ে কোথাকার।”
এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়ে প্রায়ই লজ্জিত হতে হয় অদ্বিতীকে। অদ্বিতীর মনে হয় আমার মা এমন কেন! বাবা সারাদিন বাহিরে থাকেন, সেই সকালে কাজে যেয়ে রাতে যখন ঘরে ফিরেন তখন ওরা দু’ভাই বোন ঘুমিয়ে থাকে।
ছুটির দিন ছাড়া বাবার সাথে দেখাই হয়না তেমন করে দু ভাইবোনের। আগামীকাল লাবণীর জন্মদিন। ওদের বাসায় যাওয়ার কথা মাকে বললেই মা রেগে যাবেন। বলবেন, “নভেম্বর মাসে কারো জন্মদিন মানেই ফাইনাল পরীক্ষার পড়ার ক্ষতি। ” কিন্তু অদ্বিতীর খুব ইচ্ছা মাকে নিয়ে লাবণীদের বাসায় যাবে।
লাবণীর মাকে দেখে ওর মা অন্তত এইটুক বুঝতে শিখুক মা – মেয়ে কেমন বন্ধু হয়। বাবা কে বলে মা কে রাজি করিয়েছে অদ্বিতী। অদ্বিতী, সোহান এবং মা লাবণীদের বাসায় গেলো লাবণীর জন্মদিনে। লাবণীদের বাসাটা অদ্বিতীদের মতো এতো ঝলমলে সাজানো না এবং এতো বড়ও না।
তবুও খুব ভালো লাগলো অদ্বিতীর মায়ের। একতলা টিনশেড একটি বাড়ি, চারিদিকে ফুল আর ফলের গাছ দিয়ে সাজানো। অদ্বিতীদের বসার ঘরে যেখানে দেশি বিদেশি সোপিসে সাজানো শোকেস, সেখানে লাবণীদের ড্রইং রুমে পুরো দেয়াল জুড়ে বইয়ের আলমারি। কোথায় কোন বই সব আলাদা করে মার্কার দিয়ে লেখা।
ররবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, স্টিফেন কিং, ড্যান ব্রাউন সহ আরও অনেকের বই। অদ্বিতীর মায়ের মনে হলো যেনো কোন লাইব্রেরিতে এসে পড়েছে। লাবণীর মায়ের কাছে জানতে চায় অদ্বিতীর মা…
– এতো বই কে পড়ে আপা?
– আমার বই পড়ার নেশা আছে। ছেলেমেয়ে দুজনেই বই পোকা হয়েছে৷– বলেন কি! ক্লাসের বই পড়ার পর সময় পায় কখন?
– (হেসে জবাব দেয়) যে জিনিসের প্রতি যার ভালবাসা তৈরী হয়, তার জন্য সময় বের হয়ে যায়।অদ্বিতীরা লাবণীদের বাসায় প্রায় পাঁচ ঘন্টা থেকে বাসায় ফিরলো। মায়ের ভিতরে কেমন এক পরিবর্তন দেখতে পেলো সেদিনের পর থেকে অদ্বিতী। অদ্বিতী বুঝতে পারলো লাবণীর মায়ের একটা কথা মায়ের এই পরিবর্তনের কারন।
অদ্বিতীর মা যখন লাবণীর মা কে বলছিলেন, ” অদ্বিতী লাবণীর মতো এতো পড়তে চায় না, মায়ের কথা শোনে না। ক্লাসের বইই পড়ে না তারপর তো গল্পের বই! ”
লাবণীর মা তখন বলেছিলেন, “আপা, আমার মনে হয় আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে অদ্বিতীকে বুঝতে।আমিতো লাবণীর কাছে অদ্বিতীর অনেক গল্প শুনি। আপনার মেয়েটি অত্যন্ত মানবিক। কারো কোন কষ্ট সে সহ্য করতে পারে না। অন্যের কষ্টে এগিয়ে যায়। এইতো সেদিনের একটি ঘটনা, ওদের ক্লাসের আয়ার বাচ্চাটা খুবই অসুস্থ।
ওর চিকিৎসার জন্য ছুটির পরে সব অভিভাবকদের কাছে গিয়ে সাহায্য চেয়েছে। এবং এই উদ্যোগ নিয়েছে অদ্বিতী। আপনার এতো ছোট মেয়ে কিন্তু এখনই কতোটা মানবিক। এইসব মানবিকতা বইয়ের কোথাও লেখা নেই। ”
অদ্বিতীর মায়ের মনে হতে থাকে লাবণীর মা যতোটা চেনে নিজের মেয়েকে সে অতোটা চিনতে পারেনি। কেবল “এটা করো না, ওটা করোনা ” বলে শাষণ করেছে।
শুধুমাত্র শাষণে সন্তানের বন্ধু হওয়া যায় না। অদ্বিতীর মায়ের এই প্রথম মনে হয়, প্রতিটি সন্তানের প্রথম এবং প্রধান বন্ধু মা বাবার হওয়া উচিত। বিশেষ করে বয়সন্ধীকালের পরিবর্তনের সময় মায়ের খুব বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ বাচ্চাদের বিপথে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে।
( এমন দশটি মৌলিক গল্প নিয়ে কিশোর গল্পের বই)
বই – জয় বাহিনী
বইয়ের ধরন – কিশোর গল্প
লেখক – সাফিয়া খন্দকার রেখা
প্রকাশনা – বাংলা জার্নাল
প্রচ্ছদ – মোস্তাফিজ কারিগর
বইটি পাওয়া যাবে ২০২১ এর বই মেলায়
Leave a Reply